Tuesday, May 14, 2013

ডায়াবেটিসের রোগী ও রোজা রাখা


সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশসহ বিশ্বের বেশির ভাগ দেশে ডায়াবেটিসের রোগী রোজা রাখেন। ডায়াবেটিসের রোগী, যাঁরা চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া রোজা রাখেন, তাঁরা বেশ কিছু জটিলতার সম্মুখীন হতে পারেন। বিশেষ করে রক্তে শর্করা বা চিনির স্বল্পতা (হাইপোগ্লাইসেমিয়া), রক্তে শর্করা বা চিনির আধিক্য (হাইপারগ্লাইসেমিয়া), ডায়াবেটিস কিটোএসিডোসিস ও পানিশূন্যতায় ভুগতে পারেন। যাঁরা শুধু খাবার ও ব্যায়ামের মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখেন, তাঁদের রোজা রাখায় ঝুঁকি কম। যাঁরা মেটাফরমিন ও গ্লিটাজোনস-জাতীয় ওষুধ গ্রহণ করেন, তাঁদেরও ঝুঁকি কম।
তবে যাঁরা সালফোনাইলইউরিয়া ও ইনসুলিন গ্রহণ করেন, তাঁদের ঝুঁকি বেশি। যাঁদের সামর্থ্য আছে, তাঁদের রোজা রাখতে ডায়াবেটিস কোনো বাধা নয়। তবে প্রয়োজন পূর্বপ্রস্তুতি। চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে রোজা রাখার প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন। ডায়াবেটিসের রোগীদের রোজা রাখা সহজ ও নিরাপদ। রোজা রাখা অবস্থায় রক্ত পরীক্ষা করা এবং প্রয়োজন হলে চামড়ার নিচে ইনসুলিন ইনজেকশন নেওয়া যেতে পারে। ধর্মবিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে আমরা জেনেছি, এতে রোজার কোনো ক্ষতি হয় না। সুতরাং এসব নিয়ম মেনে ডায়াবেটিসের রোগীরা রোজা রাখতে পারবেন।
রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমে যাওয়া (হাইপোগ্লাইসেমিয়া)
দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকার কারণে দিনের শেষ ভাগে স্বাস্থ্যের দিকে বেশি নজর দিতে হবে। অতিরিক্ত কাজ করায় রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমে যেতে পারে। বড় ধরনের শারীরিক বা কায়িক পরিশ্রম রক্তের গ্লুকোজের বড় একটা অংশ কমিয়ে দেয়। অতিরিক্ত ইনসুলিন অথবা ট্যাবলেট গ্রহণ করায় এ অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। ইনসুলিন ও সিরিঞ্জ একই মাপের না হলে, বরাদ্দের চেয়ে খাবার খুব কম খেলে বা খাবার খেতে ভুলে গেলে এ অবস্থা হতে পারে।
হাইপোগ্লাইসেমিয়ার লক্ষণ
অসুস্থ বোধ করা। বুক ধড়ফড় করা। শরীর কাঁপতে থাকা। চোখে ঝাপসা দেখা। অজ্ঞান হয়ে যাওয়া। খিদে বেশি পাওয়া। বেশি ঘাম হওয়া। শরীরের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলা। অস্বাভাবিক আচরণ করা। খিঁচুনি হওয়া।
হাইপোগ্লাইসেমিয়া হলে কী করতে হবে
রোজাদার ডায়াবেটিসের রোগীর এসব লক্ষণ দেখা দিলে অথবা রক্তে সুগারের পরিমাণ ৬০ মিলিগ্রামের (৩.৬ মিলিমোল) নিচে হলে রোজা ভেঙে ফেলতে হবে। পরবর্তী সময়ে কাজা রোজা রাখতে হবে। হাইপোগ্লাইসেমিয়া একটি জরুরি অবস্থা। এ রকম হলে রোগীকে সঙ্গে সঙ্গে চা-চামচের চার থেকে ছয় চামচ গ্লুকোজ বা চিনি এক গ্লাস পানিতে গুলে খাওয়াতে হবে। গ্লুকোজ বা চিনি না থাকলে যেকোনো খাবার সঙ্গে সঙ্গে দিতে হবে। রোগী অজ্ঞান হয়ে গেলে মুখে কিছু খাওয়ানোর চেষ্টা না করে গ্লুকোজ ইনজেকশন দিতে হবে এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
হাইপোগ্লাইসেমিয়া এড়ানোর উপায়
এমন খাবার ও ওষুধ খেতে হবে, যা রক্তে গ্লুকোজের মাত্রাকে স্বাভাবিক পর্যায়ে রাখবে। খাবার ও ওষুধ খাওয়ায় সমন্বয় সাধন করতে হবে। নিচের নিয়মগুলো মেনে চললে হাইপোগ্লাইসেমিয়া এড়ানো সম্ভব। কঠিন শারীরিক বা কায়িক পরিশ্রমের কাজ বাদ দিতে হবে। কেননা, এটি কোনো রকম আভাস ছাড়াই রক্তে গ্লুকোজের মাত্রাকে অত্যন্ত নিম্নমুখী করে দেয়। দেরিতে ইফতার করায়ও এমন অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। বারবার ওষুধের মাত্রার হিসাব সংরক্ষণ করতে হবে, সেটি ইনসুলিন হোক কিংবা ট্যাবলেট। একইভাবে খাবারের পরিমাণেরও হিসাব রাখতে হবে, বিশেষ করে শর্করার পরিমাণ।
এরপর এই হিসাব বিশেষজ্ঞচিকিৎসককে জানাতে হবে, যেন খাবারের মাধ্যমে রক্তে গ্লুকোজের প্রভাব উচ্চমাত্রা এবং ওষুধের সাহায্যে রক্তে গ্লুকোজের প্রভাব নিম্নমাত্রা—এই দুইয়ের সমতা রক্ষা হয়।
গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে যাওয়া (হাইপারগ্লাইসেমিয়া)
ডায়াবেটিস রোগে গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে গেলে অনেক রকম জটিলতা সৃষ্টি হয়। ইনসুলিনের ঘাটতির কারণে কম সময়ে অ্যাসিটোন বেড়ে অবস্থা জটিল হতে পারে। এসব ক্ষেত্রে প্রধান যে অবস্থাগুলো প্রকাশ পায় সেগুলো হলো—মাথা ঘোরা, দুর্বলতা, কখনো কখনো ঝিমুনি, বমি প্রভৃতি।
এ ছাড়া রক্তে গ্লুকোজের কার্যক্রম অনিয়মতান্ত্রিক হয়ে পড়ায় অতিরিক্ত প্রস্রাব, পিপাসা ও পানিশূন্যতা দেখা যায়। এ সময় রক্তচাপ নিম্নমুখী হয়, ত্বক শুকিয়ে যায়, প্রস্রাবে গ্লুকোজ বেশি মাত্রায় প্রকাশ পায় এবং সেই সঙ্গে প্রস্রাবে অ্যাসিটোন দেখা যায়। এ অবস্থায় যদি দ্রুত চিকিৎসা করানো না হয়, তাহলে কিটোএসিডোসিস হবে এবং রোগী বিপজ্জনক অবস্থায় পৌঁছাবে।
রোজা থাকা অবস্থায় এ রকম হলে রোজা ভেঙে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। কিটোএসিডোসিস ছাড়াও যদি রক্তের সুগার বিপজ্জনক অবস্থায় পৌঁছায় (১৬.৭ মিলিমোল/লি. বা ৩০০ মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার), তাহলে ত্বকের নিচে ইনসুলিন দিয়ে সুগার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এতে রোজার কোনো ক্ষতি হবে না। পরবর্তী সময়ে শুধু ডায়াবেটিসের ওষুধ সমন্বয় করতে হবে।
রোজাদার ডায়াবেটিক রোগীর খাবার
সেহিরর খাবার সেহিরর শেষ সময়ের অল্প কিছুক্ষণ আগে খাওয়া।
ইফতারের সময় অধিক পরিমাণে মিষ্টি ও চর্বিজাতীয় খাবার গ্রহণ না করা।
ডায়াবেটিসের রোগীদের পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি ও পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে, যেন তাঁরা পানিশূন্যতায় না ভোগেন। খেজুর খেলে একটা খেজুর খেতে পারেন। ফলমূল, শাকসবজি, ডাল ও টক দই তালিকাভুক্ত করতে পারেন। ডাবের পানি পান করতে পারেন। যদি কোনো পানীয় পান করেন তবে চিনিমুক্ত পানি বেছে নিতে পারেন। যদি মিষ্টি পানীয় পছন্দ করেন, তবে সুইটনার যেমন—ক্যানডেরাল বা সুইটেকস ব্যবহার করতে পারেন। ভাজা খাবার যেমন—পিঁয়াজু, বেগুনি, পুরি, পরোটা, কাবাব অল্প পরিমাণে খেতে পারেন।
খাদ্যের ক্যালরি ঠিক রেখে খাওয়ার পরিমাণ এবং ধরন ঠিক করতে হবে। সঠিক সময়ে সঠিক পরিমাণ পাওয়া প্রয়োজন।
রমজানের আগে যে পরিমাণ ক্যালরিযুক্ত খাবার খেতেন রমজানে ক্যালরির পরিমাণ ঠিক রেখে খাওয়ার সময় এবং ধরন বদলাতে হবে। পরবর্তী পাতায় কিছু নমুনা খাবার দেওয়া হলো। প্রয়োজন হলে নিউট্রিশনিস্টের সঙ্গে যোগাযোগ করে খাবারের তালিকা ঠিক করে নিতে হবে। লক্ষ রাখতে হবে ওষুধের সঙ্গে খাবারের যেন সামঞ্জস্য থাকে। ইফতারের সময় অতি ভোজন এবং শেষ রাতে অল্প আহার পরিহার করতে হবে।
রোজায় ডায়াবেটিক রোগীর ব্যায়াম
দিনের বেলায় অধিক পরিশ্রম বা ব্যায়াম করা উচিত নয়। ইফতার বা রাতের খাবারের এক ঘণ্টা পর ব্যায়াম করা যেতে পারে। মনে রাখতে হবে, তারাবির নামাজেও কিছুটা ব্যায়াম হয়ে যায়।
রোজায় ডায়াবেটিক রোগীর ওষুধ
যাঁরা দিনে একবার ডায়াবেটিসের ওষুধ খান, তাঁরা ইফতারের শুরুতে (রোজা ভাঙার সময়) ওই ওষুধ একটু কম করে খেতে পারেন।
যাঁরা দিনে একাধিকবার ডায়াবেটিসের ওষুধ খান, তাঁরা সকালের মাত্রাটি ইফতারের শুরুতে এবং রাতের মাত্রাটি অর্ধেক পরিমাণে সেহিরর আধা ঘণ্টা আগে খেতে পারেন।
যেসব রোগী ইনসুলিন নেন, তাঁদের রমজানের আগেই ইনসুলিনের ধরন ও মাত্রা ঠিক করে নেওয়া উচিত। সাধারণত রমজানে দীর্ঘমেয়াদি ইনসুলিন ইফতারের সময় বেশি এবং প্রয়োজনে শেষ রাতে অল্প মাত্রায় দেওয়া উচিত। দীর্ঘমেয়াদি এবং কম ঝুঁকিপূর্ণ ইনসুলিন (যা দিনে একবার নিতে হয়) বর্তমানে আমাদের দেশে পাওয়া যায়, তা ব্যবহার করতে পারেন। এতে হাইপোগ্লাইসেমিয়ার সম্ভাবনা অনেকটা কম।
রমজানের কমপক্ষে তিন মাস আগে ডায়াবেটিসের রোগীর অবস্থা অনুসারে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে মুখে খাওয়ার ওষুধ এবং ইনসুলিন ঠিক করা উচিত।
রমজানের প্রথম ও শেষ দিনে ওষুধকে বিশেষ করে সমন্বয় করে নিতে হবে। এই দুদিন খাবার এবং জীবনযাত্রায় বিশেষ পরিবর্তন হয়ে থাকে।
সুত্র:
মূল লেখক: মো. ফরিদ উদ্দিন সহযোগী অধ্যাপক, অ্যান্ডোক্রাইন মেডিসিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা | প্রথম আলো, তারিখ: ১৮-০৮-২০১০ এ প্রকাশিত
If You Enjoyed This Post Please Take 5 Seconds To Share It.

1 comment:

Powered by Blogger.